অবশেষে বইয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার বলেই মনে হচ্ছে। বই মানে শুধু কাগজে ছাপা হওয়া, দু মলাটের মধ্যে বাঁধাই হওয়া অনির্দিষ্ট পৃষ্ঠাসংখ্যার বস্তুগুলোকে বোঝাচ্ছি, আমাদের প্রত্যেকেরই বুকশেলফ, টেবিল আর বালিশের তলায় যেগুলোকে দেখতে পাওয়া যায়।
গত নভেম্বর মাসে এমন একটি যন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছে, যেটি খুব শিগগিরই বদলে দিতে যাচ্ছে মানুষের পুস্তক পাঠের অভ্যাস। ওই যন্ত্রের আগমনের পর এখন কাগজে ছাপা হওয়া বইয়ের প্রয়োজনই ফুরিয়ে যাবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। যন্ত্রটি নিজে ছাপা হওয়া বইয়ের জায়গা দখল করে নিতে যাচ্ছে। শুধু বইয়ের জায়গা দখল করা নয়, ওই যন্ত্র আমাদের বই কেনা আর পড়ার পুরনো পদ্ধটিও বদলে দেবে।
যন্ত্রটির নাম ‘কিন্ডল’ (Kindle) । এটি বাজারে ছেড়েছে আমাজন ডটকম (amazon.com)। ইন্টারনেট জগতের সাথে যাদের পরিচয় আছে, তারা …….
আমাজন ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস
……
জানেন, আমাজন খুই পরিচিত একটি অনলাইন শপিং পোর্টাল। প্রথমে অনলাইনে বই বিক্রি দিয়েই শুরু হয়েছিল এদের যাত্রা। এখন দুনিয়ার হেন জিনিস নেই, যা তারা বিক্রি করে না। আপনি অনলাইনে নতুন বা পুরাতন পণ্য পছন্দ করে অর্ডার দিন। দ্রুত পৌঁছে যাবে আপনার বাসায়।
আমাজন যে যন্ত্রটি বাজারে এনেছে, সেটি আকারে-প্রকারে একটি পেপারব্যাক বইয়ের সমান। ওজন ১০ দশমিক ৩ আউন্স। পাতলা যন্ত্রটার প্রায় পুরোটা জুড়ে স্ক্রিন। সেই স্ক্রিনে ফুটে উঠবে বইয়ের পৃষ্ঠা। আপনি বোতাম চাপবেন, পৃষ্ঠা বদলে যেতে থাকবে। স্ক্রিনটি কিন্তু কম্পিউটার বা ল্যাপটপের প্রচলিত স্ক্রিনের মতো আলো বিচ্ছুরণকারী স্ক্রিন হবে না। এটি হবে হুবহু বইয়ের পৃষ্ঠার মতো দেখতে। ই-ইংক (E Ink) নামে একটি প্রযুক্তির কল্যাণে এখন এটা করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্ডল-এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য : এটি হুইসপারনেট নামে এক ধরনের প্রযুক্তির মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টাই কানেকটেড থাকবে আমাজন বুক স্টোরের সাথে। আর এই কানেকটিভিটি হবে বিনে পয়সায়। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পৃথিবীর যে কোনো বই আমাজনের কাছে আছে। কিন্ডল যন্ত্র দিয়ে আপনি আমাজন স্টোরের নতুন-পুরাতন বইগুলো ঘাঁটবেন, ফ্ল্যাপ পড়বেন, চাইলে দু তিনটি পৃষ্ঠাও পড়তে পারেন, বইটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ-অবিশেষজ্ঞ নানান জনের মন্তব্য পড়বেন। তারপর পছন্দ হলো তো এই যন্ত্রের সাহায্যে অর্ডার দিয়ে দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো বইটি আপনার হাতে ধরা কিন্ডল যন্ত্রের মেমরিতে ডাউনলোড হয়ে গেল। এরকম দুশ বই অনায়াসে ঠাঁই পেতে পারে কিন্ডলের মেমরিতে। কম মনে হলে আপনি বাড়তি মেমরি চিপ ব্যবহার করে হাজার হাজার বই সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন। বাড়িতে বিশাল বুকশেলফ রাখার প্রয়োজন ফুরালো। বাসে বা ট্রেনে যেতে যেতে, বা বাসায় বিছানায় শুয়ে বা যে কোনো ভঙ্গিমায় আপনি ছাপানো বইয়ের মতো আয়েশ করে কিন্ডল যন্ত্রে ‘বই’ পাঠ করতে পারবেন। ফন্ট ছোট মনে হচ্ছে? বড় করে নিন। পাতার ব্যাকগ্রাউন্ডটা ধবধবে শাদার বদলে হালকা ব্রাউন করে নিতে পারেন পেঙ্গুইনের বইগুলোর আদলে।
ওহ, বলতে ভুলে গেছি, একবার চার্জ দিলে টানা ত্রিশ ঘণ্টা ব্যাটারি থাকবে ………
কিন্ডল
……..
কিন্ডলের। আমার মনে হয়, এর চেয়ে বেশি সময় জুড়ে কারো একটানা পঠনের প্রয়োজন পড়বে না। আরেকটা তথ্য। কিন্ডলের দাম শুরুতে রাখা হয়েছে ৩৯৯ ডলার। পরে দাম দ্রুত কমবে। আমাদের বাংলাদেশী মধ্যবিত্তদের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই চলে আসার কথা।
ইলেকট্রনিক যন্ত্রে বই পঠনের ব্যাপারটি অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই শুরু হয়েছে। কিন্ডল এখানে প্রথম নয়। ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে সিকিলন ভ্যালির কিছু ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠান রকেটবুক আর সফটবুক রিডার নামে দুটি যন্ত্র চালু করার চেষ্টা করেছিল। এরপর ২০০৬-এ বেশ সাড়াশব্দ করে আসে ৩০০ ডলার দামের সনি রিডার। কিন্ডলের সাথে সনি রিডারের অনেক…….
সনি রিডার
…….
মিল। সনি রিডারও স্ক্রিনে ব্যবহার করে ই ইংক প্রযুক্তি। এমআইটির মিডিয়া ল্যাবের উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তিটিকে পুরো দশকের সবচেয়ে বড় ব্রেকথ্রু মনে করা হচ্ছে। ই ইংক ব্যবহার করে বানানো স্ক্রিনের সাথে বইয়ের ছাপানো পাতার কোনো তফাতই আপনি ধরতে পারবেন না।
আমাজন চেষ্টা করেছে ছাপানো কাগজের বইয়ের সাথে কিন্ডলের সবরকম মিল রাখতে। ধরুন, কিন্ডলে কোনো বই পড়তে পড়তে আপনার কিছু লাইন খুব ভালো লাগলো। আপনি সেগুলো আন্ডারলাইন করে রাখতে পারবেন। বা পাশে মার্জিনে কিছু নোটও লিখে রাখতে পারবেন। সেটা আপনার হাতের লেখাসহ সেভ হয়ে যাবে।
আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস কিন্ডলকে শুধু একটা মামুলি যন্ত্র বলতে নারাজ। তিনি বলছেন, কিন্ডল হচ্ছে একটি সার্ভিস। এর মাধ্যমে আপনি বর্তমানে বাজারে ছাপা হওয়া যে কোনো বই-ই শুধু নয়, দুনিয়ায় এযাবৎকাল ছাপা হওয়া যে কোনো বই চোখের নিমেষে কিনতে পারবেন। বেজোস এটিকে পঠনের ‘আইপড’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। জেফ বেজোস হয়তো একটু বাড়িয়েই বলেছেন। কেননা উদ্বোধনের দিন ৮৮ হাজারের কিছু বেশি ই-বুক ছিল আমাজনের স্টোরে। তবে খুব দ্রুত এ সংখ্যা বাড়তে থাকবে। দুনিয়ার সব বই ই-বুক ফরম্যাটে নিতে বেশিদিন সময় লাগার কথা নয়। নতুন বইয়ের ক্ষেত্রে তো কাগজ আর ই-বুক ফরম্যাট একই সাথে তৈরি হয়ে থাকছে। পুরাতন ক্লাসিকগুলোকে ই-বুক ফরম্যাটে নিয়ে যাওয়ার কাজ এগিয়ে রেখেছে গুটেনবার্গসহ অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।
এইসব দেখেশুনে আমার বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে, কাগজের বই খুব শিগগিরই অচল বস্তুতে পরিণত হতে যাচ্ছে, ঠিক যেভাবে লং প্লে বা ম্যাগনেটিক টেপের ক্যাসেট প্লেয়ারের দিন শেষ হয়ে গেছে। মুশকিল হলো কথাটা খুব সহজে কেউ হজম করতে চায় না। ‘বই’ (মানে কাগজের বই) চিরকাল থাকবে, কোনো প্রযুক্তিই এটির বিকল্প হতে পারে না–এইরকম একটা রোমান্টিক ভাবাবেগ লেখক ও পাঠক উভয়ের মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত দেখা যায়। যারা এমন মনোভাব পোষণ করেন, তারা এটা ভুলে যান যে, কাগজের বইও আসলে একটা প্রযুক্তি। বই লেখা, প্রুফ দেখা, প্রেসে কম্পোজ করা আর শেষে যোহানেস গুটেনবার্গ নামক এক জার্মান ভদ্রলোকের উদ্ভাবিত চৌকস একটি যন্ত্রের বহুগুণে উন্নত কোনো সংস্করণে ছাপা হয়ে বাঁধাই হয়ে তারপর প্রকাশক পরিবেশক হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছতে পৌঁছতে বইকে প্রযুক্তির বহু দুরুহজটিল পথ পাড়ি দিতে হয়। …….
যোহানেস গুটেনবার্গ (১৪০০-১৪৬৮)
…….
আবেগপ্রবণ ও অভিমানী পাঠক বই নামে যে জিনিসটি তার হাতে তুলে নেন, তিনি জানেনও না যে এটি অ্যানালগ প্রযুক্তির শেষ দুর্গ। পৃথিবীতে আর সবখান থেকে অ্যানালগ প্রযুক্তি প্রায় বিদায় নিয়েছে। শূন্য আর একের মোহনীয় জাদুকরী রাজ্যে প্রবেশ করেছে প্রায় সব প্রযুক্তি।
তবে আমি কাগজের বইয়ের প্রশংসা করতে চাই। আর সেটা করতে চাই সম্পূর্ণ প্রাযুক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, প্রযুক্তির বিচারেও (কাগজের) বই একটি বিস্ময়কর ‘যন্ত্র’। বই বা পুস্তক হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকের বাসাবাড়িতে ঠাঁই নেয়া গেজেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উৎকর্ষময়। এটি যে কোনো কম্পিউটার হার্ড ডিস্কের চেয়ে ‘নির্ভরযোগ্য’ একটি স্টোরেজ ডিভাইস। এটির ইউজার ইন্টারফেস স্রেফ ‘কিলার’–মানে প্রতিদ্বন্দ্বীঘাতী। বই নামক এ যন্ত্র অকল্পনীয় রকম ইউজার ফ্রেন্ডলি। এটি ব্যবহার করতে কোনো ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়েল লাগে না, প্রয়োজন হয় না ‘অমুক ফর ডামিজ’ বা ‘তমুক ইন ফিফটিন ডেইজ’ ইত্যাদি সিরিজের গাইড ‘বই’। এই যন্ত্র সবসময় অন থাকে। এটা চালানোর জন্যে কোনো ব্যাটারি প্রয়োজন হয় না। ইউজাররা এটিকে দুনিয়ার এমনই এক সর্বৈব নিখুঁত উদ্ভাবন মনে করেন, যার আসলে আর কোনো উন্নতিই দরকার নেই।
আর অন্য যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বইয়ের সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানটি হলো, এর সঙ্গে মানুষের ধর্মীয় ও মূল্যবোধসঞ্জাত ভাবাবেগ যুক্ত থাকে। প্রায় সাড়ে ৫শ বছর ধরে মানুষ এই প্রযুক্তিটির সাথে বসবাস করতে করতে এটিকে ‘ইটারনাল’ ভাবতে শুরু করেছে। আগুন আর চাকা বাদ দিলে পৃথিবীতে আর কোনো প্রযুক্তি বোধ হয় মানুষের সাথে এতো দীর্ঘ সময় বসবাস করেনি। ফলে বই মানুষের ইহকালের পাশাপাশি পরকালেরও সঙ্গী হয়ে গেছে।
এতোকিছুর পরও পুস্তককে বোধ হয় বিদায় জানাতেই হবে। বিদায়টা পুস্তককে না জানিয়ে আসলে জানাতে হচ্ছে ছাপাখানাকে। কেননা ডিজিটাল ফর্মে বই কিন্তু থেকেই যাচ্ছে (তবে একবার দুই মলাটের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ডিজিটাল দুনিয়ায় বই যে কতখানি বদলে যাবে কে জানে। লেখক-পাঠক-সমালোচকের ইন্টারঅ্যাকটিভ ক্রীড়াক্ষেত্রকে আমরা নিশ্চয়ই প্রচলিত অর্থে বই বলতে রাজি হবো না)। স্ভেন বার্কার্টস নামে এক ভদ্রলোক দ্য ডিজিটাল গুটেনবার্গ নামে একটি বই লিখেছেন ১৯৯৪ সালে। তাতে তিনি বইয়ের নানারকম ভবিষ্যত নিয়তির চিত্র তুলে ধরার পর শেষে মন্তব্য করেছেন :‘লেখক যা লেখেন, যেভাবে লেখেন, যে পদ্ধতিতে সেটা সম্পাদনা হয়, ছাপা হয়, বিক্রি হয় আর পঠিত হয়–এই সব পুরাতন ধ্যানধারণা আজ হুমকির মুখে।’ তার এই বক্তব্য, বলাই বাহুল্য, নানান মহল থেকে প্রতিবাদের মুখে পড়েছে। যেমন অ্যানি প্রাউলক্স নামে এক ফিকশন রাইটার লিখেছেন, ‘একটা কম্পমান অস্থির ছোট্ট স্ক্রিনের সামনে বসে কেউ উপন্যাস পড়বে না। কখনই না।’ অ্যানি এ কথা লিখেছেন ১৯৯৪ সালে। আজ ২০০৮ সালে কম্পিউটার স্ক্রিন সর্বত্র ছেয়ে গেছে। আর সেগুলো ১৯৯৪ সালের মতো কম্পমানও নয়। বহু মানুষ এই স্ক্রিনে ডকুমেন্ট, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন আর্টিকল, গল্প পড়ছে। আর চ্যাটিং আর ব্লগিংয়ের মাধ্যমে কতো ঘণ্টা যে এই শাদা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকছে মানুষ, তা এখনও কেউ যোগ করে আমাদের বলেনি, না বলাই ভালো। ১৯৯৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আমি ইকোনমিস্ট পত্রিকাটি হাতে নেড়ে দেখিনি। অথচ ওই পত্রিকার আমি প্রায় নিয়মিত পাঠক। Gutenberg.org থেকে শ চারেক বই নামানো আছে আমার কম্পিউটারে। যার অন্তত দুটি আমি কম্পিউটারেই পড়ে শেষ করতে পেরেছি। ব্যাপারটা অভ্যাসের। নিউজউইক ম্যাগাজিনের টেকনোলজি এডিটর তার আইফোনে পড়ছেন বসওয়েলের লাইফ অফ জনসন বইটি। আগামী দিনে নাকি অ্যাপলের এই আইফোনই হবে ই-বুক পাঠের প্রধান মাধ্যম। শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকার এক কলামিস্ট জানিয়েছেন, তিনি জেন অস্টিনের উপন্যাসগুলো পড়ে ফেলছেন তার ব্ল্যাকবেরিতে (এবার আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না ব্ল্যাকবেরি কী। না জানলে টিভিতে গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপন দেখুন)।
তবে বইকে একেবারে মামুলি একটা প্রযুক্তি বলে এক কথায় উড়িয়ে দিতে ডিজিটাল ব্যবসায়ী জেফ বেজোসও রাজি নন। কাগজের বইয়ের তিনি নিজে একনিষ্ঠ পূজারি। বেজোস বলেন, ‘আমি বহুবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি, বই নামক এই ফিজিক্যাল অবজেক্টগুলোকে আমি এতো ভালোবাসি কেন? কেন আঁঠা আর কালির গন্ধ আমার এতো ভালো লাগে? এর উত্তর হলো, বই পাঠ আমাকে যে জগতগুলোয় নিয়ে যায়, সেইসব জগতের সাথে আমি এই পরিচিত গন্ধগুলোকে একাকার করে দেখি। আমরা আসলে ভালোবাসি শব্দ আর ভাবনাকে।’
সাইবারস্পেস নামক মায়াবি দুনিয়া সৃষ্টির আগে বই আমাদের টেনে নিয়ে যেতো এক জাদুকরী অন্তর্লোকে। ভিক্টর নেল ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার লস্ট ইন আ বুক বইতে পাঠকের এক হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতির কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বই হলো আমরা দেখতে চাই, এমন সকল স্বপ্নের সমষ্টি। আর স্বপ্নের মতোই এরা আমাদের চেতনাকে বদলে দিতে পারে।’ খুব পছন্দের কোনো বই নিবিষ্টভাবে পড়তে পড়তে অনেকের মধ্যে যে সম্মোহিত দশা সৃষ্টি হয়, নেল তার নাম রেখেছেন ‘লুডিক রিডিং’ (ল্যাটিন ভাষায় লুডো মানে ‘আমি খেলি’)। অ্যান প্রাউলক্স দাবি করেছেন, ইলেকট্রনিক বই কখনই পারবে না এই সম্মোহিত, তন্ময় দশায় পাঠককে নিয়ে যেতে।
মাইক্রোসফট কোম্পানির ই-রিডিং বিভাগের প্রধান বিল হিল অবশ্য এ কথা মানতে রাজি নন। তিনি এই সম্মোহিত দশার মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করেছেন। তিনি ‘জেনারেল থিওরি অব রিডাবিলিটি’ বা ‘পঠনযোগ্যতার সাধারণ নিয়ম’ নামে একটা নিয়ম দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। এই তত্ত্ব লুডিক রিডিং-এর পেছনের রহস্য উদঘাটন করবে। বিল হিল বলছেন, চোখের…….
গুটেনবার্গ বাইবেল
……..
কর্নিয়ায় কোনো ছবি পড়লে সেটা বিদ্যুৎ তরঙ্গের আকারে স্নায়ুপথে বাহিত হয়ে মস্তিষ্কের সেই অংশটিতে চলে যায়, যেখানে সকল সংকেত আর প্রতীককে অর্থে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। এই পুরো পথটি চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। বিল জানাচ্ছেন, আমাদের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটা হাই-রেজোল্যুশন স্ক্যানিং মেশিন। এটা সেকেন্ডে পাঁচটা টার্গেটকে স্ক্যান করতে পারে এবং এক টার্গেট থেকে আরেক টার্গেটে সরে যেতে সময় নেয় মাত্র ২০ মিলিসেকেন্ড। আর এই কাজটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালিয়ে যেতে পারে মস্তিষ্ক। প্রায় সাড়ে ৫শ বছর ধরে মানুষ বই পড়ছে। এই দীর্ঘ সময়ে বই আকার ও ডিজাইনের দিক থেকে নিজেকে এমনভাবে বিবর্তিত করে নিয়েছে যে, এখন আমাদের মস্তিষ্কের পঠন প্রক্রিয়ার সাথে এটা চমৎকারভাবে খাপ খায়। বইয়ের ফন্ট, এক শব্দ থেকে আরেক শব্দের দূরত্ব, দুই লাইনের মধ্যে ফাঁক, দুপাশের মার্জিন–ইত্যাদি সবই আমাদের মস্তিষ্কের পঠন উপযুক্ততার সাথে সাজুয্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে কম্পিউটার স্ক্রিনকে যদি বইয়ের জায়গা নিতে হয়, তাহলে বইকে হুবহু নকল করতে হবে। হিল অবশ্য প্রচলিত স্ক্রিন পাল্টে অন্যরকম স্ক্রিন চালুর পক্ষপাতি নন (ই ইংকের মাধ্যমে কিন্ডল এবং সনি রিডার যা করেছে)। তিনি প্রচলিত স্ক্রিনেই বইয়ের ফরম্যাট বদলের পক্ষপাতি। সেটা তার চাকরিরই অংশ অবশ্য।
তবে হিল স্বীকার করেছেন যে, টেলিভিশন আকৃতির একটা ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ স্ক্রিন মানুষের পঠনের সবচেয়ে উপযুক্ত অভিজ্ঞতা নয়। আপনি ডান বা বাম হাতে ধরে নিজের চোখ থেকে সুবিধাজনক একটা দূরত্বে যে জিনিসটাকে বসাতে পারছেন, বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে যে জিনিসটাকে মোচড়াতে পারছেন, সেটাই হলো পঠনক্রিয়ার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। আর কিন্ডল এবার সেই কাজটাই মানুষকে করতে পারার সুযোগ করে দিয়েছে। ‘ই ইংক’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতি ইঞ্চিতে ১৭৬ ডটের যে স্ক্রিন কিন্ডল উপহার দিয়েছে, তাতে সিসিলিয়া নামক একটি শেরিফ ফন্টে সাজানো অক্ষর সম্ভবত সেই একই অনুভূতি সৃষ্টি করতে সক্ষম, ভিক্টর নেল যেটার নাম দিয়েছেন লুডিক রিডিং, আমরা নাম দেই তন্ময় পাঠ।
এ তো গেল পাঠকের দিক থেকে বিবেচনা। কিন্ডল আরো বড় বিপ্লবটি ঘটাতে যাচ্ছে প্রকাশনা শিল্পের ময়দানে। পুস্তক প্রকাশনার ব্যবসা অত্যন্ত ধীরগতির ব্যবসা হিসেবে বিশ্বজুড়েই পরিচিত। ভিডিও গেমের ব্যবসার লাভ যেখানে তিন ডিজিটের দিকে ছুটছে, সেখানে এক ডিজিটই পার হতে চায় না বইয়ের ব্যবসার লাভ। এরকম স্থবির ব্যবসায় কিছুটা গতি আনতে পারবে হয়তো কিন্ডল। সব বই ই-বুকে রূপান্তরিত হয়ে কিন্ডলের মাধ্যমে ডাউনলোডেড হতে থাকলে প্রকাশকদের সবচেয়ে বড় যে সুবিধাটা হবে, সেটা হলো কোনো বই কখনই আউট অফ প্রিন্ট হবে না। তাছাড়া বইয়ের দামও অনেক কমে আসবে। বইয়ের দাম নিয়ে পাঠকদের অভিযোগ চিরকালের। ই-বুকের আকার পেলে বইয়ের দাম অনেক কমে আসবে এতে সন্দেহ নেই। কেননা কাগজ আর প্রেসের খরচ বলে কিছুই এখানে থাকছে না।
বই নামের এ দুর্গ খুব শিগগিরই হয়তো ভেঙে পড়বে না। কাগজের বই না থাকলে আমরা হয়তো মানুষের কল্পনাশক্তির অনেক মজার উপকরণ হারাবো। এটা ঠিক যে, কাগজের বই না থাকলে লাইব্রেরি অফ বাবেল সহ বোর্হেসের অনেক গল্প লেখাই হতো না, কিংবা আরব্য রজনীর সেই তন্ময় পাঠকের গল্পটিও তৈরি হতো না বইয়ের পৃষ্ঠায় মাখানো বিষে যার মৃত্যু ঘটেছে। আবার ডিজিটাল বই হয়তো মানুষের কল্পনার নতুন এক ফ্লাডগেট খুলে দিতে পারে। হয়তো লেখকত্বের ধারণাই বদলে যাবে অবিরাম কানেকটেড বইয়ের জগতে।
বইয়ের পবিত্রতায় যারা অটল, তাদেরকে মাইক্রোসফটের বিল হিলের একটা বিবরণ শোনাতে চাই। কীভাবে বই তৈরি হয়, বিল হিল আমাদের সেই চিত্রটি এভাবে কল্পনা করতে বলেছেন : আমরা অরণ্যের গাছ কাটি, সেই গাছের মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাই পেপার মিলে, সেখানে গাছকে পিষে মণ্ড তৈরি করি, সেই মণ্ড আরেকটা কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তৈরি করা হয় কাগজের লম্বা রোল, সেই রোল জাহাজে করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তারপর সাদা কাগজের দেহে কিছু ময়লা কালি মাখিয়ে সেই কালি মাখানো কাগজ কেটে ভাজ করে বাঁধাই করে সেটা আবার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হয়। আর সেটাকে আমরা বলি বই। এই প্রক্রিয়া কি আরো ৫০ বছর ধরে এভাবেই চলতে থাকবে আশা করা যায়?
এখন বাজারে কিন্ডল আসার পর সম্ভবত এ প্রশ্নের জবাব হবে, না আশা করা যায় না।